বেণুদি নেই। এই অনুভূতির অর্থ, আমার অভিভাবক নেই। অসুস্থ ছিলেন ঠিকই। কিন্তু বেণুদি যে এমন ভাবে হঠাত্ চলে যাবে, আমি ভাবতেও পারিনি।

শেষ দিকে শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন বেণুদি। মুখের দিকে তাকিয়ে অনাবিল হাসতেন। বছর দু’য়েক আগে একটি বিজ্ঞাপনে এক সঙ্গে শেষ কাজ করেছিলাম। খুব টাইট শিডিউল ছিল। লাইনগুলো সে ভাবে মনে রাখতে পারতেন না তখন। কিন্তু মেকআপ নিয়ে একবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেই সেই চেনা ক্যারিশ্মা। মনে হত, এই তো আমাদের সুপ্রিয়া দেবী।

শেষেরও একটা শুরু থাকে। সেই শুরুটা হল, বেণুদির সংসার করার গাইডেন্স। আমার স্বামী অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়কে অনেক ছোট থেকে দেখছেন, খুবই স্নেহ করতেন। অনেকেই ভাবেন হয়তো বেণুদির থেকে রান্না করা শিখেছি আমি। তা তো আছেই। তবে মূলত শিখেছি সংসার করা।

প্রায় ১০ বছর আগের কথা। তারও আগে হতে পারে। সে সময় টেলিভিশনে কাজ করছেন বেণুদি। অগ্নির এক সঙ্গে অনেকগুলো কাজ চলছে। বেণুদি আর সাবুদি একটা মেকআপ রুম শেয়ার করতেন। আমি তখন ওঁদের কস্টিউম করতাম।

সে সময় আমার বয়স অনেকটাই কম ছিল। অগ্নির ওপর অভিমান বেশি, মন কেমন বেশি। অগ্নির চারপাশে নায়িকারা ঘিরে থাকত। তখন বেণুদি বলেছিলেন, তোমার স্বামী সুন্দর দেখতে হবে, আবার তাঁকে নায়িকারা ঘিরে ধরবে না, এ তো হয় না। তোমার স্বামীকে সবাই তাকিয়ে দেখবে, আর সে কারও দিকে তাকাবে না, তা আবার হয় নাকি? তাই প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে, তুমি কেমন স্বামী চাও।


বেণুদি শিখিয়েছিলেন, ধৈর্য্য ধরতে হবে। সংসার করতে গেলে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হবে। আর বারবার বলতেন, মেয়েদের অনেক শক্তি দিয়ে তৈরি করেছেন ভগবান।

বেণুদির হাতের রান্নার তো কোনও তুলনা হয় না। আমার রান্নার শো-এ বহুবার এসেছেন। একটা সময় তো অগ্নির জন্য রান্না করে নিয়ে আসতেন। আমরা ওর খাওয়া হয়ে গেলে প্রসাদের মতো পেতাম।

রান্না তো আমি মূলত শিখেছি বংশীদার কাছে। বেণুদির বাড়িতে যিনি ওঁকে সাহায্য করতেন, সেই বংশীদা। মহানায়কের পছন্দের সব রান্না বেণুদি করতেন। আর বংশীদা পাশে থাকত।

এমনিতে তো মাংস, ভেটকি পাতুরি, কাঁটা চচ্চড়ি— এ সবের কথা অনেকেই জানেন। মহানায়কের পছন্দের এ সব খাবার। কিন্তু বেণুদি দারুণ নিরামিষ রান্নাও করতেন। ফুলকপি, কড়াইশুঁটি দিয়ে পনির করতে শিখিয়েছিলেন। আমাকে বলতেন, সরষের তেলের ঝাঁঝটা আগে মেরে নিবি। মহানায়ক ওটা একদম সহ্য করতে পারতেন না। নাক দিয়ে জল বেরতো। গলা চোকড হয়ে যেত। তাই বলতেন, আগে সরষের তেল ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নিবি। শিশিতে ঢেলে রাখবি। তার পর যখনই নিরামিষ রান্না হবে, ওই তেলটা ব্যবহার করবি।

এ সব কত স্মৃতি— সত্যিই আজ সব স্মৃতি হয়ে গেল।

খবর - আনন্দবাজার পত্রিকা